ক্যান্সার ও উপবাসের যোগসূত্র
এই লেখাটি ইউটিউব চ্যানেল “দ্য ডায়েরি অফ এ সিইও”-তে আপলোড করা “World No.1 Fasting Expert: The Link Between Cancer & Fasting That They’re Hiding From You!” শিরোনামের ভিডিও থেকে নেওয়া হয়েছে; যেখানে Dr. Alan Goldhamer তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের কথা তুলে ধরেন।
ডাঃ অ্যালান গোল্ডহ্যামার ৪০ বছর ধরে উপবাসের মাধ্যমে স্বাস্থ্য এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে একজন অগ্রগামী চিকিৎসক। প্রধানত জল উপবাসের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা তিনি উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যান্সার, এবং ডায়াবেটিসের মতো জীবনযাত্রাজনিত রোগের চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকর বলে দাবি করেন। আলোচনায় উপবাসের পদ্ধতি, যেমন প্রতিদিন ১২ ঘন্টা উপবাস এবং পর্যায়ক্রমিক দীর্ঘ উপবাসের সুবিধাগুলি ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যা শারীরিক পরিবর্তন যেমন কেটোসিস এবং অটোনোমিক নার্ভাস সিস্টেমের ভারসাম্য আনয়নে সহায়ক। এছাড়াও, স্বাস্থ্যকর জীবনধারা এবং পুষ্টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যেখানে চিনি, তেল এবং লবণ (এসওএস)-মুক্ত খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে।
উপবাস এবং ক্যান্সারের সংযোগ: এক নতুন দিগন্ত?
ক্যান্সার শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়। এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই এবং এটি প্রতিরোধের উপায় খুঁজতে বিশ্বজুড়ে গবেষণা চলছে। আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি, মানুষ এমন কিছু পদ্ধতির সন্ধান করছে যা শরীরকে ভেতর থেকে শক্তিশালী করতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, উপবাসের মতো একটি প্রাচীন প্রথা নতুন করে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এটি এখন আর কোনো প্রথাগত ধারণা নয়, বরং একটি জৈবিক প্রক্রিয়া, যা ক্যান্সারসহ বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী রোগ নিয়ন্ত্রণে কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞান গভীরভাবে গবেষণা করছে। এই আর্টিকেলে আমরা উপবাসের পেছনের আশ্চর্যজনক বৈজ্ঞানিক দিকগুলো তুলে ধরব। বিশেষজ্ঞরা কীভাবে উপবাসকে কোষীয় পর্যায়ে শরীরের সুরক্ষার একটি শক্তিশালী উপায় হিসেবে দেখছেন, তা জানার জন্য প্রস্তুত হন। এই আলোচনা থেকে আপনি এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাবেন যা আপনার স্বাস্থ্য ভাবনায় নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
——————————————————————————–
১. শরীরের নিজস্ব ‘রিসাইক্লিং’ প্রক্রিয়া: অটোফেজি এবং ক্যান্সার কোষের অপসারণ
কল্পনা করুন, আপনার শরীরের ভেতরেই রয়েছে এক স্বয়ংক্রিয় ‘রিসাইক্লিং’ ব্যবস্থা, যা ২৪ ঘণ্টা ধরে আবর্জনা পরিষ্কারে ব্যস্ত। বিজ্ঞানীরা এই অসাধারণ প্রক্রিয়াটির নাম দিয়েছেন অটোফেজি (Autophagy)। সহজ ভাষায়, অটোফেজি হলো শরীরের ‘নিজেকে খেয়ে ফেলার’ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীর তার ক্ষতিগ্রস্ত, ত্রুটিপূর্ণ কোষ, বর্জ্য পদার্থ এবং এমনকি সম্ভাব্য ক্যান্সার কোষগুলোকে চিহ্নিত করে ধ্বংস করে ফেলে। এটি অনেকটা ঘরের আবর্জনা পরিষ্কার করে ঘরকে পরিচ্ছন্ন রাখার মতো।
গবেষণায় দেখা গেছে, উপবাস এই অটোফেজি প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করার একটি অন্যতম শক্তিশালী উপায়। যখন আমরা খাওয়া থেকে বিরত থাকি, তখন শরীর শক্তি সংরক্ষণের জন্য তার অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবহার করতে শুরু করে এবং এই পরিচ্ছন্নতার কাজটি আরও কার্যকরভাবে সম্পাদন করে। এই প্রক্রিয়ার সাথে ক্যান্সারের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। অটোফেজি শরীরের সেনেসেন্ট কোষ (senescent cells) বা ‘বৃদ্ধ’ কোষগুলোকে অপসারণ করতে সাহায্য করে, যেগুলো সঠিক সময়ে পরিষ্কার না হলে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিষয়টি এমন নয় যে উপবাস করলে আয়ু দ্বিগুণ হয়ে যায়, বরং অতিরিক্ত খাওয়ার অভ্যাসই শরীরের এই অত্যাবশ্যকীয় পরিচ্ছন্নতার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে আয়ু অর্ধেক কমিয়ে দেয়। ইঁদুরের ওপর করা গবেষণার উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে:
“it’s not that fasting doubles your lifespan it’s overfeeding cuts it in half… by overfeeding the rodents they’re developing fat visceral fat they get the inflammation and you cut their lifespan in half.”
সুতরাং, উপবাস শরীরকে তার স্বাভাবিক নিরাময় প্রক্রিয়ায় ফিরে যেতে সাহায্য করে, যা ক্যান্সার প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
——————————————————————————–
২. ভিসেরাল ফ্যাট: প্রদাহ সৃষ্টিকারী গোপন শত্রু এবং উপবাসের লক্ষ্য
শরীরে চর্বি বা ফ্যাট মানেই যে খারাপ, তা নয়। তবে সব ফ্যাট একরকম নয়। আমাদের ত্বকের নিচে যে ফ্যাট থাকে (সাবকুটেনিয়াস ফ্যাট), তার চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক হলো ভিসেরাল ফ্যাট (visceral fat), যা পেটের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন লিভার, কিডনি এবং অন্ত্রের চারপাশে জমা হয়। এই ফ্যাটকে শরীরের এক গোপন শত্রু বলা চলে।
বিশেষজ্ঞরা ভিসেরাল ফ্যাটকে “প্রদাহ-সৃষ্টিকারী” (pro-inflammatory) এবং “অতিরিক্ত বিপাকীয়” (hyper metabolic) হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এটি অনেকটা টিউমারের মতো আচরণ করে, কারণ এটি ক্রমাগত এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে যা শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এই প্রদাহই হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের অন্যতম প্রধান কারণ।
উপবাসের একটি অসাধারণ দিক হলো, এটি বিশেষভাবে ভিসেরাল ফ্যাট কমাতে অত্যন্ত কার্যকর। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, যে রোগীরা দুই সপ্তাহ শুধুমাত্র পানি পান করে উপবাস করেছেন, তাদের মোট শরীরের ওজন কমেছে ১০% এবং মোট ফ্যাট কমেছে ২০%। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, তাদের ভিসেরাল ফ্যাটের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৪০%। এটি একটি অভাবনীয় ফলাফল, কারণ সাধারণ ডায়েট বা ব্যায়ামের মাধ্যমে ভিসেরাল ফ্যাট এত দ্রুত কমানো প্রায় অসম্ভব। তাই, শুধুমাত্র ওজন কমানো নয়, বরং এই বিপজ্জনক ফ্যাটকে শরীর থেকে দূর করে দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে উপবাস একটি অনন্য ভূমিকা পালন করে।
——————————————————————————–
৩. একটি বাস্তব উদাহরণ: লিম্ফোমা এবং ২১ দিনের ওয়াটার ফাস্টের বিস্ময়কর ফলাফল
উপবাসের কার্যকারিতা বোঝার জন্য একটি বাস্তব উদাহরণ অত্যন্ত শক্তিশালী হতে পারে। ফলিকুলার লিম্ফোমা (follicular lymphoma), যা এক ধরনের ক্যান্সার, তাতে আক্রান্ত একজন মহিলার ঘটনা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রায় দুই বছর ধরে তার এই রোগ ক্রমান্বয়ে বাড়ছিল।
প্রচলিত চিকিৎসার পরিবর্তে, তিনি তিন সপ্তাহ বা ২১ দিন শুধুমাত্র পানি পানের মাধ্যমে উপবাস করার সিদ্ধান্ত নেন। ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। উপবাস চলাকালীন, তার শরীরের টিউমারগুলো অদৃশ্য হতে শুরু করে। চিকিৎসকের ভাষায়, “you could literally feel these tumors disappearing” অর্থাৎ, হাতে অনুভব করেই বোঝা যাচ্ছিল যে টিউমারগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে।
তবে গল্প এখানেই শেষ নয়। এই রোগীকে পরবর্তী ১০ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং তিনি ক্যান্সারমুক্ত ছিলেন। এর পেছনের রহস্য ছিল উপবাস পরবর্তী জীবনযাত্রায় কঠোর পরিবর্তন। তিনি সম্পূর্ণভাবে উদ্ভিদ-ভিত্তিক এবং এসওএস-মুক্ত (SOS-free) অর্থাৎ লবণ, তেল এবং চিনি ছাড়া খাবার গ্রহণ করতেন।
বিশেষজ্ঞরা এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট করেছেন: এটি ক্যান্সারের “নিরাময়” (cure) নয়, বরং এটি একটি “ব্যবস্থাপনা” (management) কৌশল। উপবাসের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক অসাধারণ ফল পাওয়া গেলেও, এর সুফল ধরে রাখার জন্য রোগের মূল কারণ, অর্থাৎ অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রাকে অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। এটি নিছক কোনো গল্প নয়, বরং বিজ্ঞানসম্মত পর্যবেক্ষণের এক দারুণ উদাহরণ।
——————————————————————————–
৪. গাট মাইক্রোবায়োম ‘রিবুট’: হজমতন্ত্র থেকে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের উন্নতি
আমাদের অন্ত্রে ট্রিলিয়ন সংখ্যক অণুজীবের এক বিশাল জগৎ রয়েছে, যা সম্মিলিতভাবে গাট মাইক্রোবায়োম (gut microbiome) নামে পরিচিত। এই বাস্তুতন্ত্র আমাদের হজম, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং এমনকি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও অপরিহার্য। আধুনিক খাদ্যাভ্যাসের কারণে প্রায়ই এই মাইক্রোবায়োমের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, যা নানা রোগের কারণ হতে পারে।
উপবাস আমাদের গাট মাইক্রোবায়োমের জন্য একটি ‘রিবুট’ বাটনের মতো কাজ করে। যখন আমরা উপবাস করি, তখন অন্ত্রের অণুজীবের সংখ্যা ব্যাপক হারে কমে যায়, যার মধ্যে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াও থাকে। এটি অনেকটা কম্পিউটারকে রিস্টার্ট করার মতো, যা সিস্টেমকে নতুন করে শুরু করার সুযোগ দেয়।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ৭ দিনের ওয়াটার ফাস্টিংয়ের ফলে ফিউসোব্যাকটেরিয়াম (Fusobacterium) নামক ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা ৮০% এর বেশি কমে যায়।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো উপবাস ভাঙার পরের সময়টা, অর্থাৎ ‘রিফিডিং’ (refeeding) পিরিয়ড। এই সময়ে স্বাস্থ্যকর, সম্পূর্ণ উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাবার গ্রহণের মাধ্যমে অন্ত্রকে উপকারী ব্যাকটেরিয়া দিয়ে পুনরায় popoluate বা সমৃদ্ধ করার সুযোগ তৈরি হয়। যেহেতু আমাদের শরীরের ৯০-৯৫% সেরোটোনিন এবং ডোপামিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটার অন্ত্রে তৈরি হয়, তাই একটি সুস্থ মাইক্রোবায়োম শুধুমাত্র হজম নয়, বরং ডিপ্রেশন এবং অ্যাংজাইটির মতো মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতেও সাহায্য করতে পারে।
উপসংহার
উপবাস শরীরকে ভেতর থেকে পরিষ্কার করার এক শক্তিশালী প্রাকৃতিক উপায়। এটি কোষীয় পর্যায়ে পরিচ্ছন্নতা (অটোফেজি) চালু করে, বিপজ্জনক ভিসেরাল ফ্যাট কমায়, এবং অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমকে ‘রিবুট’ করার সুযোগ দেয়। কিছু ক্ষেত্রে, যেমন লিম্ফোমার বাস্তব উদাহরণে আমরা দেখেছি, এর ফলাফল হতে পারে অভাবনীয়। তবে মনে রাখা জরুরি, উপবাস একটি শক্তিশালী চিকিৎসাপদ্ধতি যা বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে করা উচিত। এর সবচেয়ে বড় সার্থকতা তখনই, যখন এটি মানুষকে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভ্যাস গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। এখন প্রশ্ন হলো: আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি, উপবাসের মতো প্রাচীন জ্ঞানকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার একটি অংশ হিসেবে গ্রহণ করা কি দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধের ভবিষ্যৎ হতে পারে?